স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকার আরো একটু আন্তরিক হলেই উড়বে স্বপ্নের উড়ান।

 স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকার আরো একটু আন্তরিক হলেই উড়বে স্বপ্নের উড়ান। 

প্রতিনিধি অনুপম পাল। । 

কৈলাসহর,ঊনকোটি ত্রিপুরা 

রাজ্যের পুরোনো বিমানবন্দরের মধ্যে রাজধানী আগরতলার পর সবচাইতে জনপ্রিয় বিমানবন্দর ছিলো বর্তমান ঊনকোটি জেলার কৈলাসহর বিমানবন্দর। যা মূলত উত্তর-পূর্ব ভারতের ভৌগোলিক গুরুত্ব এবং স্থানীয় মানুষের প্রয়োজনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৬০ এর দশকে। যদিও সরকারী উদাসীনতা ও আন্তরিকতার অভাবে বর্তমানে এটি ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে রয়েছে। তবে ত্রিপুরার এই বিমানবন্দরের ইতিহাস এবং সম্ভাবনা নিয়ে মানুষের আগ্রহ এখনও বর্তমান।

কৈলাসহর বিমানবন্দরটি ১৯৬০-এর দশকে প্রথম চালু হয়। তৎকালীন ভারত সরকারের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সংযোগ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করার অংশ হিসেবে এই বিমানবন্দরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। কৈলাসহরের অবস্থান এবং ত্রিপুরার অন্যান্য অঞ্চলের সাথে যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তার কারণে এই বিমানবন্দরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বিশেষ করে আসাম রাজ্যের বহু যাত্রীরা কোলকাতা কিংবা দেশের অন্যত্র যেতে হলে কৈলাসহরের বিমানবন্দর থেকেই যাত্রা করতেন। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশের বহু যাত্রীরা ভারতের উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা নিতে কিংবা পর্যটন কেন্দ্র পরিদর্শনে আগ্রহীরা কৈলাসহর বিমানবন্দর থেকেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যেতেন। এই বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠার পর মূলত ছোট বিমানের ওঠানামার জন্য উপযুক্তভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল।

শুরুর দিকে বিমানবন্দরটি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যারা আগরতলা বা ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন করতেন। পর্যটকদের ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, কারণ ত্রিপুরার এই অংশে অনেক ঐতিহাসিক এবং প্রাকৃতিক আকর্ষণ রয়েছে। বিশেষ করে কৈলাসহর তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য খ্যাত একটি মনোরম শহর। যার প্রবেশদ্বারে রয়েছে প্রাচীন শিলা-কাটা ভাস্কর্য এবং জটিল খোদাইয়ের জন্য পরিচিত ঊনকোটির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ,যা এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি আভাস দেয়।

রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ এর দশকে একটি বড় এবং উন্নত বিমানবন্দরের উন্নয়ন শুরু হলে গুরুত্ব কমতে থাকে কৈলাসহর বিমানবন্দরের। অন্যদিকে, নতুন নতুন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং রেলপথের উন্নয়নও এই বিমানবন্দরটি প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দেয়। ফলে, কৈলাসহর বিমানবন্দর অব্যবহৃত এবং অকার্যকর অবস্থায় চলে যায় ১৯৯০ এর দশকে।

কৈলাসহর বিমানবন্দর পুনরায় চালুর জন্য বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে ঊনকোটি জেলাবাসীর বিশেষ দাবীর মধ্যে কৈলাসহর বিমানবন্দর চালু করার দাবী ছিলো প্রথম পর্যায়ে। কৈলাসহর মহকুমার উন্নয়ন মঞ্চ বিমানবন্দর চালু করার জন্য বহু আন্দোলন সংগঠিত করেছে। ২০১৮ সালে রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পূর্বে কৈলাসহর বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে বিমানবন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকা বিমানবন্দর চালু নিয়ে অভিনব কিছু আন্দোলন সংগঠিত করে। এছাড়াও বর্তমান রাজ্য সরকারের প্রধান বিরোধী দল গুলোও এ নিয়ে সুর চড়াও করতে থাকে। যার ফলে তৎকালীন সময়ে বর্তমান রাজ্য সরকারের বিভিন্ন নেতৃত্বরা তাদের রাজনৈতিক প্রচারে বিমানবন্দর দ্রুত চালু করার আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজ্যে বাম শাসনের অবসান ও ভারতীয় জনতা পার্টির প্রতিষ্ঠার প্রায় ৭বছর অতিক্রান্ত হলেও কিছু আশ্বাস আর বিমানবন্দর চালু করার নামে পরিদর্শন ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি ঊনকোটি জেলাবাসীর। 

২০২৩ সালের আগস্টে, ত্রিপুরার পরিবহন মন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বিমানবন্দর পরিদর্শন করে এবং এটিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রস্তাব দেয়। 

কৈলাসহর থেকে কংগ্রেস বিধায়ক বীরজিৎ সিনহার বিধানসভায় উত্থাপিত প্রশ্নের এক উত্তরে, মন্ত্রী শ্রী চৌধুরী বলেছিলেন যে বিমানবন্দরের দক্ষিণ প্রান্তে মনু নদীর উপস্থিতির কারণে এবং উত্তরে ঘন জনসংখ্যা সহ একটি সড়ক থাকার কারণে মন্ত্রক একটি বাধা সীমাবদ্ধতা সমীক্ষা চালিয়েছিল।প্রাথমিক সমীক্ষায় সংক্ষিপ্ত ফ্লাইটের জন্য ছোট ২০- সিটের বিমান চালানোর সুপারিশ করা হয়েছিল এবং সেই অনুযায়ী বিমানবন্দরের অবকাঠামো সংস্কার করা হয়েছিল। তবে রানওয়ের দৈর্ঘ্য অপর্যাপ্ত হওয়ায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাড়পত্র পায়নি বিমানবন্দরটি।

স্থানীয়দের ধারণা বিমানবন্দরটি পুনরায় চালু হলে তা স্থানীয় পর্যটন শিল্পে বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারে, এবং কৈলাসহর ও ত্রিপুরার অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারে। বিশেষ করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের পর্যটন শিল্পের উন্নতির জন্য এই বিমানবন্দরটি কার্যকর হতে পারে।

বিভিন্ন সময়ে রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকারের পক্ষ থেকে কৈলাসহর বিমানবন্দর পুনরুজ্জীবনের বিষয়ে(২০১৮ সালের পরে) পরিকল্পনা করা হলেও তা এখনও বাস্তবে রূপান্তরিত হয়নি। তবে বর্তমান সময়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের উন্নয়নের জন্য যে নানা পরিকল্পনা এবং প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে কৈলাসহর বিমানবন্দর পুনরুজ্জীবিত হতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।

কৈলাসহর বিমানবন্দর পুনরায় চালু হলে ত্রিপুরার উত্তরাঞ্চলীয় এলাকাগুলোর উন্নয়নের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। এতে ব্যবসায়িক সুযোগ বৃদ্ধি করবে এবং স্থানীয় জনগণের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের পর্যটন ও বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ত্রিপুরাকে প্রতিষ্ঠিত করতে কৈলাসহর বিমানবন্দর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

বিমানবন্দরটি পুনরুজ্জীবিত হওয়া মানে স্থানীয় পর্যটন ও ব্যবসার জন্য আরও ভালো সুযোগ তৈরি হবে। এটি উত্তর-পূর্ব ভারতের সংযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে সহায়ক হবে এবং এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে।

কৈলাসহর বিমানবন্দরের ইতিহাস এবং সম্ভাবনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কীভাবে একসময় গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা সময়ের সাথে সাথে বিস্মৃত হয়েছে। তবে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা এবং উন্নয়নের মাধ্যমে এটি আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। স্থানীয় জনগণের সমর্থন, রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তায় যদি এটি পুনরায় চালু হয়, তবে ত্রিপুরা এবং কৈলাসহর উভয়ের জন্যই এটি এক নতুন দিনের সূচনা হবে। তাই জেলাবাসীর দাবী রাজ্য সরকার আরো একটু আন্তরিক হলে কৈলাসহর বিমানবন্দর থেকে উড়বে স্বপ্নের উড়ান।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ