প্রেস রিলিজ “চাঙমা জিধু বিঝু সিধু”

 প্রেস রিলিজ 

“চাঙমা জিধু বিঝু সিধু”

সকল সম্মানীয় সাংবাদিক বন্ধুদের আগাম বিঝুর শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জ্ঞাপন করছি।

সুপ্রাচীনকাল থেকেই চাকমা আদিবাসীরা পালন করে আসছেন ঐতিহ্যবাহী ‘বিঝু উৎসব’। সমাজ চিন্তার সাথে জড়িয়ে আছে লোকসংস্কৃতি। এই লোকসংস্কৃতি সমাজের ধারক ও বাহক।

এ বছর সনাবজরী বিজু উৎসব পালিত হচ্ছে ঊনকোটি জেলার মাছমারায়। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রাম থেকেই আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল বিঝু উৎসব উদ্‌যাপনের‍। আজ ইতিহাস। সূচনা কেউ ভাবতে পারেনি সেদিনের উৎসব ইতিহাসে পরিণত হবে।

চাকমা আদিবাসীদের বিঝু উৎসবের সাথে বাঙালিদের চৈত্র সংক্রান্তি একই সময়ে পালন করা হয় । ওই একই সময়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীদের মধ্যে বিঝু উৎসবের প্রায় অনুরূপ উৎসব পালিত হতে দেখা যায়। যেমন---ভারতবর্ষের আসামে চৈত্রমাসের শেষে মহা সমারোহে ‘বিহু’ উৎসব পালিত হয়। ত্রিপুরার বিভিন্ন আদিবাসীদের মধ্যে একই সময়ে বৈইসু বা বিঝু উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে ককবরকভাষী আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী গড়িয়া পূজা অনুষ্ঠিত হয়‍। এছাড়া ঝাড়খন্ড এলাকার আদিবাসীরাও বলতে গেলে একই সময়ে ‘বাহাপরব’ উদ্‌যাপন করে থাকেন। মায়ানমারের আরাকানে মগ আদিবাসীরা এবং বাংলাদেশের মারমা আদিবাসীরা ‘সাংগ্রাই’ উৎসব পালন করেন। 

‘বিঝু’ শব্দের প্রকৃত অর্থ কি তা নিয়ে নানা মত আছে। এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয় ঋক বৈদিক শব্দ ‘বিষুবত’ থেকেই ‘বিঝু’ শব্দের উৎপত্তি। মার্চ মাসের ২০ বা ২১ তারিখ সূর্য বিষুব রেখা অতিক্রম করে উত্তর গোলার্ধে কর্কট ক্রান্তির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সাধারণত এই সময়ে খানিক বৃষ্টিপাত হয় ভারত সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়। যেহেতু এই সম‍য়ে খানিক বৃষ্টিপাত হয় যা ফসল উৎপাদনে উপযোগী সময়। তাই এই অঞ্চলের অধিবাসীদের মোটামুটি একই সময়ে তাদের নববর্ষ বা নতুন ফসল উৎপাদনের মধ্য দিয়ে সূচনা হয়।

বিঝু উৎসব চাকমা আদিবাসীদের জাতীয় উৎসবে পরিগণিত হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। পৃথিবীর যে দেশে চাকমা আদিবাসীরা রয়েছেন, সেখানে বিঝু উৎসব পালন করেন মহাসমারোহে। বিশেষ করে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, মা‍য়ানমার, ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হয়। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্রান্স প্রবৃতি দেশে বসবাসকারী চাকমা আদিবাসীরা বিঝু উৎসব পালন করে থাকেন তাই বলতে হয়--- ‘চাকমা জিদু বিঝু সিধু’। 

যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় বহন করে চলেছে তাদের ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব সংস্থা কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভাষার মধ্যে লুকিয়ে আছে ঐতিহ্যের অহংকার। বিঝু উৎসব চাকমা আদিবাসীদের চিরাচরিত ঐতিহ্যকে গৌরবান্বিত করে তুলেছে।

১৯৭৪ সালে প্রথম মাছমারায় সূচনা  হয়েছিল আনুষ্ঠানিকভাবে বিঝু উৎসব উদযাপনের। ১৯৮২ সালে বিঝু উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত বিঝুমেলা তৎকালীন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী পরিদর্শন করেন। তিনি এই উৎসবের ব্যপকতা বুঝতে পেরে ১৯৮৩ সাল থেকে বিঝু উৎসব উপলক্ষে মূল বিঝু দিনটি (অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেস দিন) বিঝু উৎসব উপলক্ষে সরকারী ছুটি ঘোষনা করেন। পাশাপাশি রাজ্যের চাকমা অধ্যুষিত ব্লক এলাকায়  এই উৎসব উৎযাপনের জন্যে আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করেন। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে  সরকারীভাবে আনুষ্ঠানিক  রাজ্য ভিক্তিক বিঝুমেলা সূচনা হয়। এই মেলাটি প্রথম পেঁচারথলে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর এই উৎসব ও মেলা এক বছর উত্তরে হলে পরের বছর দক্ষিনে এভাবে চক্রাকারে সারারাজ্যে উদযাপিত হয়। 

২০১৮ সাল থেকে রাজ্যের অন্যান্য সরকারী মেলার সমতুল্য ভাবে বিঝু উৎসব পালিত হচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনের দামাদোলে বিঝুমেলা উৎসব উদযাপন করা সম্ভব হয়নি এবং ২০২১ সালে কারোনা মহামারির কারণে বিঝু উৎসব উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি। 

২০২৪ খ্রিস্টাব্দে সনাবজরি বিঝু উৎসব ও মেলা ত্রিপুরা রাজ্যের ঊনকোটি জেলার মাছমারায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে আগামি ১১ই এপ্রিল থেকে ১৫ই এপ্রিল, ২০২৪। প্রথম দিন অর্থাৎ ১১ এপ্রিল ফুল বিঝুর আগের দিনে সন্ধ্যা ৪টায় ৫ দিনের এই মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন ত্রিপুরা রাজ্য চাকমা সামাজিক পরিষদের রাজ্য কারবারি  দেবযান চাকমা, সমাজপতি। মঙ্গলবার প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই তথ্য জানান ৫০তম রাজ্যভিত্তিক বিঝু মেলা কমিটির সেক্রেটারি সজল বিকাশ চাকমা। তিনি আরো জানান, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ত্রিপুরা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গঙ্গা প্রসাদ প্রসেইন, ভেনঃ জ্যোতিপালা ভিক্ষু, বিশিষ্ট সমাজ সেবক, মায়ানমার, ত্রিপুরা রাজ্য বিঝু মেলা সোসায়টি সেক্রেটারি আনিরুদ্ধ চাকমা, এদে দেরগাঙ সুলয়ানি কারবারি বিমল দেওয়ান, পরিমল চাকমা, লেখক, বাংলাদেশ সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বগণ। উদ্বোধনী পর্বের পর অনুষ্ঠিত হবে মনব্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।   

        পাঁচদিন ব্যাপী মেলার দ্বিতীয় দিনে ১২ এপ্রিল ফুল বিঝুতে বিকেল ৪টায় শুরু হবে আলোচনা সভা। ওইদিন মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন পদ্মশ্রী স্মৃতি রেখা চাকমা, বেইন কাবিল,  ডঃ পদ্মা কুমারি চাকমা, স্বর্ণ পদক প্রাপ্ত বাংলা ভাষায়, চিকনবি চাকমা, হেঙ্গ্রঙ কাবিল, সুস্মিতা চাকমা, প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা, জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত, কল্পনা চাকমা, চাগালা কারবারি, মাছমারা বাম। আলোচনা সভার পর অনুষ্ঠিত হবে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।  

           মেলার তৃতীয় দিনে ১৩ এপ্রিল মূল বিঝুতে বিকেল ৪টায় শুরু হবে আলোচনা আর গুনিজন সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান। এদিন অনুষ্ঠানে সম্মানীয় অতিথি হিসেবে মেলা প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকবেন ত্রিপুরা রাজ্য চাকমা সামাজিক পরিষদের রাজ্য কারবারি (সমাজপতি) দেবযান চাকমা, অনিল কুমার চাকমা, বিশিষ্ট সমাজ সেবক, অভীক কুমার চাকমা, কিংবদন্তী গায়ক, ১৯৭৪ সালের প্রথম বিঝুমেলা কমিটির সম্মানীয় সদস্য/সদস্যা, রাজ্য চাকমা সামাজিক পরিষদের অন্তর্গত শাখা প্রশাখার অন্যান্য সদস্য/সদস্যা, আর ও ছাত্র জধা, কর্মচারী জধা, গাবুচ্ছে জধা সহ অন্যান্য সংঘটনের সভাপতি সহ অন্যান্য সদস্য/সদস্যা। এইদিনই সমাজের বিশিষ্ট গুনিজনদের বিভিন্ন বিভাগে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ গুনিজন সম্বর্ধনা দেওয়া হবে। সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের পর অনুষ্ঠিত হবে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।   

মেলার চতুর্থ দিনে ১৪ এপ্রিল গচ্ছেপচ্ছে দিনে বিকেল ৪টায় শুরু হবে অনুষ্ঠান। এদিন অনুষ্ঠানে সম্মানীয় অতিথি হিসেবে মেলা প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকবেন অভিজিত ভট্টাচার্য, প্রতিষ্ঠাতা, স্কুল অফ সাইন্স, ডঃ নিরমল দাস, ডিরেক্টর, উত্তর পূর্বাঞ্চল অরেল লিটারেচার, গৌতম লাল চাকমা, লেখক, যোগামায়া চাকমা, বিশিষ্ট কবি, লেখিকা প্রমুখ। আলোচনা সভার পর অনুষ্ঠিত হবে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।  

মেলার সমাপ্তি দিনে ১৫ এপ্রিল বিকেল ৪টায় শুরু হবে আলোচনা অনুষ্ঠান। এদিন অনুষ্ঠানে সম্মানীয় অতিথি হিসেবে মেলা প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকবেন শান্তি বিকাশ চাকমা, সাধারন সম্পাদক, ত্রিপুরা রাজ্য চাকমা সামাজিক পরিষদ, ডঃ মিলন রানি জমাতিয়া, প্রফেসর, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, গোপাল চাকমা,সুলয়ানি কারবারি, আগেরে দেরগাঙ, দিপক চাকমা, শিক্ষক জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত, অনিল চন্দ্র চাকমা, চাগালা কারবারি, মাছমারা চাগালা। আলোচনা সভার পর অনুষ্ঠিত হবে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।   

                 মেলার পাঁচদিনেই ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে বিশিষ্ট শিল্পীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান, নৃত্য পরিবেশন করবেন। এছাড়া মেলাকে ঘিরে ময়দানে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন স্টল থাকবে। খাবারের স্টলের পাশাপাশি, বয়ন শিল্প সামগ্রী সহ বিভিন্ন দোকানপাট থাকবে। সেই সাথে চাকমা জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী ভবচক্র, লরবো-মিদুঙী ঘর, জুম ঘর ইত্যাদি প্রদর্শন করা হবে। রাজ্যের সকল অংশের মানুষকে ৫দিনের এই মেলায় অংশ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে মেলা উদযাপন কমিটি।

এই উৎসবের মধ্য দিয়ে সকল মানুষের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ, গ্লানি ভুলে আনন্দ ও উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসিত হোক‍‍।

“সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু”

“জগতের সকল প্রাণী সূখী হউক”  

(সজল বিকাশ চাকমা)

𑄇𑄝𑄨𑄘𑄳𑄠𑄬 𑄋𑄴, 𑄻𑄶 𑄛𑄧𑄣𑄴𑄣 𑄢𑄬𑄎𑄳𑄠

কাবিদ্যাঙ, ৫০ পল্লার রেজ্য

𑄇𑄝𑄧𑄢𑄴 𑄝𑄨𑄏𑄪𑄟𑄬𑄣 𑄇𑄧𑄟𑄨𑄑𑄨

কাবর বিঝুমেলা কমিটি

𑄟𑄍𑄴𑄟𑄢, 𑄃𑄬𑄘𑄬 𑄘𑄬𑄢𑄴𑄉𑄋𑄴, 𑄃𑄯𑄚𑄧𑄇𑄮𑄑𑄨 𑄖𑄳𑄢𑄨𑄛𑄪𑄢

মাছমারা, এদে দেরগাঙ, ঊনকোটি ত্রিপুরা

                        মঙ্গলবার বিকেলে আগরতলা প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিঝু মেলা কমিটির পক্ষ থেকে নিরঞ্জন চাকমা, গৌতম লাল চাকমা, সজল বিকাশ চাকমা, উত্তরা চাকমা, শান্তি কমল চাকমা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ